আপনার ধান্ধা কি ???


আজকাল আমাদের সমাজে এমন লোক খুঁজে পাওয়া মুশকিল যে কোন না কোন ধান্ধার পেছনে ঘুরছে না? উঠতি বয়সের তরুণ থেকে শুরু করে বয়সী কর্মজীবি মানুষ, সবাই একটার পর একটা ধান্ধায় সমস্ত জীবন পার করে দিচ্ছে। নিজের ধান্ধা ছাড়া অন্য কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় কারো নেই। সবার মুখে একই কথা “ভাই আমি খুবই ব্যস্ত, আমার কোন সময় নেই।” আসুন আমরা দেখি কোন ধান্ধার পেছনে আমরা পাগলের মত ছুটে চলেছি আর কি নিয়েই বা সমাজের তরুণ বৃদ্ধ সবাই এত ব্যস্ত।

এখনকার দিনে তরুণদের একমাত্র ধান্ধা হচ্ছে যত বেশী পারা যায় ফুর্তি করা, আনন্দে থাকা, জীবনের স্বাদ উপভোগ করা। সবার মধ্যে একই চিন্তা কিভাবে একটা ‘অ্যাফেয়ার’ করা যায়। একটা বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড খুবই প্রয়োজন - “তা না হলে জীবনটাই বৃথা” এরকম একটা মানসিকতা সবার মধ্যে। হলিউড-বলিউড সংস্কৃতির তীব্র আগ্রাসন তাদের চিন্তার জগতকে এতটাই দখল করে নিয়েছে যে এসব ছাড়া অন্য কোন কিছু তারা ভাবতেই পারে না। বিয়ের আগে প্রেম, সেক্স এগুলো এখনকার দিনের ফ্যাশন। লেকের পাড়ে, পার্কে, লাইব্রেরীর বারান্দায় সর্বত্র যুগলদের সদাসর্বদা ব্যাপক উপস্থিতি এখন আর কারোরই চোখ এড়ায় না। আজকাল ছেলে মেয়ে সম্পর্ক শুধু ‘নির্দোষ প্রেম’ কিংবা বিয়ের সম্পর্ক নয় - এসব ক্ষেত্রে এমন অনেক কিছুই ঘটে যা এখন ওপেন সিক্রেট। ছেলেরা একটা ‘মেয়ে’ খুজঁছে সর্বত্র, সর্বক্ষণ। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হিন্দি ছবি, মিউজিক ভিডিও, সিনে ম্যাগাজিন কিংবা সাইবার ক্যাফেতে ডাউনলোড করা পর্নোছবি সব কিছুতেই ছেলেদের একটাই ধান্ধা - একটা মেয়ে। ছেলেদের এই ধান্ধা পূরণের জন্য সমস্ত নগর জুড়ে চলছে আরো নানা আয়োজন - কনসার্ট, ফ্যাশন শো, সুন্দরী প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।

বারে গিয়ে দামী বিদেশী মদ, বিয়ার ইত্যাদি সম্ভব না হলেও অন্ততপক্ষে ‘ডাইল’ কিংবা ‘ইয়াবা’ এর ফিলিংস নেয়া বর্তমান প্রজন্মের অনেক তরুণের কাছে আরেকটি ধান্ধা। আর এই ধান্ধার পেছনে ছুটতে গিয়ে তারা চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে।

বয়সের সাথে সাথে আমাদের ধান্ধাও পাল্টায়। শিক্ষা জীবনের শেষে যুবকদের মাথায় ঢোকে ক্যারিয়ারের ধান্ধা। এখন তার মাথায় একটাই চিন্তা কিভাবে, কাকে ধরে, ঘুষ কিংবা তোষামোদ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়। সহসাই সে বুঝতে পারে চাকুরীর বাজারে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা অনেক, তাই তাকে ‘জ্যাক’ ধরতে হবে। শুরু হয় ‘মামা’ খোঁজার ধান্ধা।

বয়স যখন পঁয়ত্রিশ কোঠা পেরোয় আর সংসার জীবন শুরু হয় তখন তার ধান্ধাও পাল্টে যায়। এখন তার আসল ধান্ধা কিভাবে ধন সম্পদ আরো বাড়ানো যায়। এজন্য বৈধ অবৈধ যেকোন পন্থা অবলম্বন করতে সে রাজি। এখন এটাই তার একমাত্র ‘মাথাব্যাথা’। একটা ধান্ধা পূরণ হলে তাকে আরেকটা ধান্ধার নেশায় পেয়ে বসে। টাকাই হচ্ছে চূড়ান্ত ধান্ধা। যেন এটা একটা ড্রাগ যা ছাড়া সে বাঁচতে পারেনা।তার সমস্ত চিন্তা, কথা ও কাজের পেছনে একটাই উদ্দেশ্য - টাকা উপার্জন। একটাই মাপকাঠি - আর্থিক লাভক্ষতি। লাভ হলে সে কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করে বা কথা বলে আর লাভের সম্ভাবনা না থাকলে তা করে না। যত টাকা আর সম্পদ তত ‘সম্মান, ‘গুরুত্ব’,

‘স্ট্যাটাস’, আর ‘নিরাপত্তা’ - এটাই আজকের সমাজের প্রচলিত ধারণা জীবনের সফলতার।

এবার থামুন এবং চিন্তা করুন

প্রকৃতপক্ষে আমরা যারা এই ধান্ধা কালচারের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে আছি তারা কিন্তু খুব বেশী চিন্তা-ভাবনা করে এটা গ্রহণ করিনি। জীবনের সফলতার এই ধারণাকে আমরা অন্ধভাবে গ্রহণ করেছি। কখনও প্রশ্ন করিনি এই ধারণাটি কি ঠিক না ভুল? বরং আমরা সমাজে আগে থেকেই যে সব ধান্ধা প্রচলিত আছে সেগুলোকে অন্ধভাবে অনুকরণ করছি মাত্র। আমরা সব সময় সমাজের বাকী লোকদের সাথে নিজেকে তুলনা করি এবং তাদের সাথে ধন সম্পদ উপার্জন আর ভোগ বিলাসের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই। কিন্তু কখনও জানতেও চেষ্টা

করিনা আমাদের সমাজের লোকদের এই চিন্তা ও কাজ কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

জীবন ধরে শুধুমাত্র বস্তুগত ও ইন্দ্রিয় সুখের(organic need and instinctual pleasure) জন্য একটার পর একটা ধান্ধার পেছনে ছুটে চলবে, একজন বিবেকবান মানুষের কাছে এটা কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমরা দেখি মানুষের চেয়ে অনেক বড় এবং শক্তিশালী প্রাণীদেরকেও মানুষ পোষ মানায় এবং নিজের কাজে ব্যবহার করে। ফলে মানুষ পৃথিবীতে শাসন করে, প্রাণীরা নয়। মানুষের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ থাকার কারণেই মানুষ এটা করতে পারে আর তা হলো তার নিজ ও তার চারপাশের জগতকে নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা।

মানুষকে অবশ্যই এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে হবে এবং তার চারপাশের জগত, তার নিজের জীবন এবং অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। শুধুমাত্র খাওয়া দাওয়া ভোগ বিলাস আর সন্তান জন্ম দিয়ে পশুর মত সমস্ত জীবন কাটিয়ে দেয়া মানুষের কাজ হতে পারেনা। তাকে অবশ্যই জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান লাভ করতে হবে।

সে কিভাবে কোথা থেকে এ পৃথিবীতে এসেছে? তার জীবনের উদ্দেশ্য কি? এই জীবনের পরে কি ঘটবে?

ইসলাম মানুষকে তার জীবনের মৌলিক প্রশ্নাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার তাগিদ দেয়। পবিত্র কোরআনের শত শত আয়াতে মানুষকে তার চারপাশের বাস্তব জগতকে মনোযোগের সাথে পর্যবেক্ষণ করার জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে। বিশ্বজগত তথা সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, দিনরাত্রির আবর্তন, প্রাণীকূল, বৃক্ষরাজি, বিভিন্ন বর্ণের মানুষ ও তাদের মুখের ভাষা ইত্যাদি হাজারো বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এদের মধ্যেকার জটিল সুনিপুণ ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনা করে আল্লাহ মানুষকে চরম সত্যে উপনীত হবার জন্য আহবান করছেন।

কোরআনে আয়াতের পর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষকে মূক, বধির ও অন্ধের মত নিজের চারপাশে ঘটমান বাস্তবতাকে উপেক্ষা না করার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন।

“নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিবারাত্রির আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে সেই সব মানুষদের জন্য যারা চিন্তাশীল।” (সূরা আলি ইমরান:১৯০)

“এবং তার নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবী, তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র; অবশ্যই এসব কিছুই নিদর্শন সেই সব লোকদের জন্য যারা জ্ঞানী।” (সূরা আর রূম:২২)

ইসলাম পৌরাণিক কল্পকাহিনী কিংবা মানুষের চিন্তাপ্রসূত কুসংস্কারের উপর গড়ে ওঠা কোন জীবনব্যবস্থা নয়। অনুমান অথবা অন্ধ ধারণা নির্ভর তত্ত্বের কোন স্থান ইসলামে নেই। মহান স্রষ্টা আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তার সর্বশেষ পয়গম্বর হিসাবে হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর নবুওয়তের বুদ্ধিগ্রাহ্য সুনিশ্চিত প্রমাণসহই ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসাবে মানব জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে আমাদের এই জীবনটাই সবকিছু নয়। মৃত্যুর পর আরও একটি জীবন আছে যেখানে আমাদেরকে এই জীবনের সকল কাজের জবাবদিহি করতে হবে। এটা একটা সুনিশ্চিত বিষয়।

আজকের দিনে আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, যা আমরা করি এবং করিনা আর যে সব ধান্ধায় আমরা দিনরাত ডুবে থাকি এসবই এসেছে আমাদের সমাজের প্রচলিত চিন্তাহীন প্রবৃত্তি(instinct) নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতি থেকে। আমাদের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি হবে, আমরা যা নিয়ে ব্যস্ত তা আমাদেরকে বাস্তবে কতটা রক্ষা করতে পারে এবং পারবে এসব নিয়ে সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা-ভাবনা করিনা বলেই আজকে আমরা এসব তুচ্ছ ধান্ধার পেছনে অন্ধ উম্মাদের মত ছুটে চলেছি। দাসত্ব করছি আমাদের নিজের খেয়াল খুশী কিংবা অন্য মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছার।

ইসলাম এসেছে মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে শুধুমাত্র আল্লাহর দাসত্বে নিয়োজিত করার জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন,

“পার্থিব জীবনতো ক্রিড়া-কৌতুক ব্যতিত কিছুই নয়, যারা সাবধানতা অবলম্বন করে (আল্লাহর ব্যাপারে) তাদের জন্য রয়েছে পরকালে উত্তম প্রতিদান। তবুও কি তোমরা বুঝবে না।” (আল কোরআন-০৬:৩২)

ইসলামে যদিও বা আল্লাহর দাসত্ব করে মহান স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনকেই মানব জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসাবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে তারপরেও মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং প্রবৃত্তিকে কখনও অস্বীকার করা হয়নি। কিন্তু তাই বলে সব ধরণের কামনা বাসনার যথেচ্ছা পূরণই মানবজীবনের উদ্দেশ্য(objective of life) হতে পারেনা।

আজকের সমাজে ইসলামকে বিশেষ কিছু আচার অনুষ্ঠানের সমষ্টি বলে মনে করা হচ্ছে । আমরা যে বিশ্বাস লালন করি তা আমাদের মধ্যে কোন চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে আসেনি, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করছি মাত্র। ফলে সারাদিনে বা সারা সপ্তাহে দু’একবার কিছু শব্দ উচ্চারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে আমাদের ইসলাম যার সাথে আমাদের দৈনন্দিন কার্যাবলীর কোন সম্পর্ক নেই। আল্লাহ, রাসূল (সা:), আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম - এ বিষয় গুলো আমাদের সমাজের লোকদের কাছে অনেক দূরব বিষয়। কারও কারও কাছে দূর অতীতের ইতিহাস বা গল্প মাত্র। তারা মনে করে এগুলোকে গুরুত্ব দেয়া বা না দেয়া যার যার ব্যক্তিগত বিষয়; দৈনন্দিন, সামাজিক, অর্থনৈতিক কার্যাবলীর ক্ষেত্রে এসব বিষয় টেনে আনা অপ্রাসঙ্গিক। ফলে প্রতি শুক্রবারে (friday muslim)আমরা যে দলে দলে মসজিদে যাই কিংবা লক্ষ লক্ষ মানুষ রমজানে(ramadan muslim) রোযা রাখে তার কোন প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া সমাজে প্রতিফলিত হয়না। অনেক ক্ষেত্রে আমরা জানিও না কিংবা প্রশ্নও করিনা বছরের পর বছর ধরে এসব আচার অনুষ্ঠান কেনইবা আমরা পালন করছি। যার ফলে আমরা পরিণত হয়েছি ‘মডারেট ফ্রাইডে মুসলিম’ এ। আসলে আমাদের জীবন চলে আমাদের নিজের ধান্ধা নিয়ন্ত্রণে, ইসলামের সাথে যার কোন সম্পর্কই নেই।

এখন সময় এসেছে আমাদের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার। আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করা উচিত কেন আমরা আমাদের ধান্ধাগুলোর পেছনে এরকম অন্ধ উম্মাদের মত ছুটে চলেছি। আমরা কি আমাদের জীবন ও মৃত্যুকে পাল্টে দিতে পারি? আমরা কি অমর হতে পারব? আমরা যদি আরও বেশী ধন সম্পদ জড়ো করি তাহলে কি মৃত্যুকে ঠেকাতে পারব? অবশ্যই উত্তর হচ্ছে - না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“অবশ্যই প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করতে হবে।” (সূরা আলি ইমরান:১৮৫)

আসুন আমরা এখন থেকেই ইসলামকে বুদ্ধি বিবেচনা ব্যবহার করে জানতে চেষ্টা করি এবং সে অনুযায়ী আমাদের জীবন ও সমাজকে পরিচালনা করতে শুরু করি। এটা আমাদের ব্যক্তিস্বত্ত্বার মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনবে এবং সমাজের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন,

“হে মানুষ, কিসে তোমাকে তোমার মহামহিম পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করল?” (সূরা আল ইনফিতার:০৬)

0 comments: